Rose Good Luck নিজস্ব বৃত্তে Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:৩৮:৩৫ দুপুর

ঘোর কুয়াশায় ঢাকা সকাল। মনে হচ্ছে ভোর। আসলে সোয়া আটটা। ভার্সিটির নির্জন কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিলো হীরক আর তৃণা। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই একে অন্যের ছায়ার মত। দুই বন্ধু, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। দু'জন ভারী শীতের কাপড় আর ঘন কুয়াশার আড়ালে দুটো ছায়ার মত পাশাপাশি হাটছে। স্টেপগুলি ভারী। পা জমে আছে। হীরকের শুধু নাক আর মুখের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তৃণার মুখ খোলা। তার গায়ের উলেন কার্ডিগানটা বেশ গরম, আরাম।

হীরকের সারা বছর ভোরে গোসলের অভ্যাস। ওর একটু বেশিই ঠান্ডা লাগছিল। সে তৃণার দিকে ফিরে হাসল, 'একটু কাছে আয় তো... আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ। দেখ, এখানে কি শীত। আমাকে তোর কার্ডিগানের ভিতরে নে। উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে রাখ।'

তৃণা হীরকের এই বেকায়দা কথাবার্তাগুলির সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে পরিচিত। হীরককেও সে খুব ভালো চেনে। এখন যদি তৃণা এক পা- ও কাছে যায় হীরক গালি দিতে শুরু করবে, 'বেহায়া, শয়তানের অস্ত্র তোরা!.. ' সে মৃদু হাসল। কিছু বলল না।

অবশ্য আজ হীরককে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। উদাস। কিছু ভাবছে। তৃণা হাঁটতে হাঁটতে তাকে এক পলক দেখে।

হীরক অন্যমনষ্কভাবে বলল, 'আমি সবসময়েই তোর আশে পাশে আছি। আমি তোকে ভালোবাসি।' একটু থেমে তৃণার দিকে তাকিয়ে আবার পথের দিকে চোখ ফিরাল। হিসাবের সুরে বলল, 'ভালোবাসা কি আমি তোর কাছ থেকে শিখেছি?

তোকে এতো অপমান করেছি, তারপরও তুই আমার। আবার তুই ও আমাকে অপমান করেছিস, তারপরও আমি তোর। আমিই একটু বেশী করেছি, তাই আমি তোকে একটু বেশী ভালোবাসি। তুই একটু কম বাসিস।'

কিছুক্ষণ দু'জন চুপচাপ হাটতে থাকল। সামান্য পথ। মাঝামাঝি চলে এসেছে। দুই পাশের পাহাড়ের অপরূপ নির্জনতার অপার্থিব সুখ তাজা ফুলের ঘ্রাণের মত নি:শ্বাসে বুক ভরে নিচ্ছিলো ওরা। পাখিরা ঘর ছাড়ছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে।

হীরক হঠাৎ কথা বলে উঠল, ' ভালোবাসা আর ঘৃণা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। ' একটু থেমে বলল,'আমার একটা স্বপ্ন- তোর হাত ধরে এই কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাওয়া। হেঁটে যেতে যেতে বাতাসে তোর খোলা চুল উড়বে । দু'একটা চুল তোর চোখ ঢেকে দিবে। তোর শরীর থেকে বুনো ফুলের ঘ্রাণে আমি মাতোয়ারা হবো। আমি ঘাড় বেঁকিয়ে তোর দিকে ফিরে তোর নিঃশ্বাসের দূরত্বে চলে আসবো! '

হীরকের কথাগুলি যেন আর কোথাও থেকে ভেসে আসছিল! শব্দের উৎস গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। তৃণা নি:শব্দে হীরকের অনুভুতিগুলি অণুসরণ করছিল। সে একটু একটু কাঁপছিল। মুখটা গরম হয়ে গেছে। সে একেবারেই চুপচাপ মাথা নিচু করে হাটতে থাকল।তার ভয় হচ্ছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যেন সে কিছুতেই তার বন্ধুর জীবনে পদস্খলনের কারণ না হয়। সমস্ত মন দিয়ে তৃণা হীরকের ইচ্ছেগুলো অনুভব করছিল। হীরক অস্পষ্ট গলায় একমনে বলে যাচ্ছিল, 'এরপর...এরপর তোর চোখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে দেবো। যাতে তুই আমাকে দেখতে পারিস।' হীরক তৃণার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,' তুই কি আমাকে পুরোপুরি কখনো দেখেছিস?পুর্ণ দৃষ্টি দিয়ে? আমাকে তোর দেখতে ইচ্ছে করে না?'

তৃণা নি:শ্বাস গোপন করল। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সীমা মানবে। বিয়ের এক মূহুর্ত আগেও কেউ কারো দিকে আর কখনো হাত বাড়াবে না। হীরকের স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। অনেকটা গল্প বলার মত। হীরক বলছিল, 'তোর ঠোটের উপরে ঘামে ভেজা ত্বক একটু একটু করে কাঁপছে...তুই অস্ফুটে আমায় কিছু বলতে চাইছিলি?

তৃণার ঠোঁটে একটু হাসির রেখা ফুটল। ঠান্ডায় গরমের দিনের কল্পনাতে সুখ খুঁজছে হীরক। সে বলল,' বলতে চেয়েছিলাম -"ভালো লাগছে তোর?" '

হীরক মুখ তুলে একবার আকাশ দেখল। বলল, ' মুহুর্তটা একটা প্রচন্ড কামনার ভাব উদ্রেক করেছিল আমার... এই নির্জন পাহাড়ঘেরা যায়গায় শুধু তুই আর আমি... কত কিছুই তো হতে পারত... ক্ষণিকের পদস্খলন... কিন্তু একটা স্বর্গীয় অনুভূতি এসে আমাকে বদলে দিল। আমি শুধু তোর নাকের পাশের তিলটিকে আলতো ছুঁয়ে দিলাম....আবার তোর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম... একটা প্রশান্ত সবুজ উদ্যানের দিকে।' জ্যাকেটের পকেটে রাখা হাতগুলির মুঠি খুলে দিল সে। বাইরে আনল না।

এক মূহুর্ত চুপ থেকে কিছু ভাবলো হীরক। একটু হাসল। বলল, 'বন্ধুর হাত ধরাটাই আসল ব্যাপার। ওখানে সকল শান্তি... পরম নির্ভরতা।'

জ্যাকেটের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে স্বপ্নচোখে হীরক পথের শেষে তাকিয়ে আছে - দৃশ্যটা দেখে তৃণা পূর্ণশ্বাস ফেলে হাসল, ' হ্যা '..

শহীদ মিনারে চলে এসেছে ওরা।

হীরক একটু হেসে বলল, 'আলহামদুলি'ল্লাহ! আমরা ফিরতে পারলাম!'

সে মুখ থেকে মাফলার সরিয়ে ফেলল। পিঠের হালকা ব্যাগের ফিতা ঠিক জায়গায় নিতে নিতে বলল, 'আমি তোকে অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক... ভালোবাসি! তুই কি বুঝিস?'

তৃণা হাসল,'হ্যা '..সে হীরকের গল্পের শেষে পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছিল। হীরক বাস্তবে হাত কখনও বাড়ায়নি ঠিকই, অন্যদিন হীরকের বুনো সব চিন্তা আর ইচ্ছে তৃণাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ভোগ করত। আজ সে শান্তি পেয়েছে.. তার খুব ভালো লাগছিল।

হীরকের মুখে কিছুটা বিষাদের আভাস। সে বলল, 'একটা জিনিস দেখ, অন্য বন্ধুরা যারা তোর আর আমার কথা জানে, ওরা মনে করে আমরা আর দশজনের মত। কিন্তু - '

কিন্তুটা তৃণা জানে। এই কিন্তুটার জন্যই সে হীরককে বেশি ভালোবাসে। সম্মান করে। সতেজ একটা হৃদয়। স্বচ্ছ বিবেক। অনেক কিছুই সে অন্যদের চেয়ে অন্যভাবে দেখে। এই যে এই ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন তা কেবল বাস্তবে না ছুঁয়ে থাকার জন্য। সে তার অনুভুতির স্বীকৃতি চায়, কিন্তু, পাপকে সে মেনে নিতে পারে না। সে কল্পনাতে জীবন কাটায়, কিন্তু মিথ্যা বলেনা। ঠকায় না। তাকে নিয়ে অন্য বন্ধুদের মত অন্যদের সাথে ফান করে না। এই নারকীয় উল্লাসের পৃথিবীতে মানুষটা ভিন্ন। শুরুটা তাদের অন্যদের মতই দেখাচ্ছিল। অন্য দশটা সম্পর্কের মত পরিণতি তারা চায়নি। যা হবে ফেয়ার হোক। চারপাশের পৃথিবীর সমস্ত অনাচারে ব্যথিত মন দুটি স্বেচ্ছায় সব চেনা জানা কিছু থেকে, সমস্ত বাজে অভ্যাস থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে এনেছে। তাদের পৃথিবী স্বচ্ছ, সুন্দর।

' আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য আমাদের যুদ্ধটা কি ওরা জানে? প্রেম হৃদয় থেকে শুরু হয়ে দেহে পৌঁছে গেলে আবার হৃদয়ে ফিরে আসা কতটা টাফ, সেটা ওরা কখনোই বুঝবে না।'

তৃণা বলল,'ওদেরকে কী দোষ দেবো? বাইরে থেকে আর ভিতর থেকে তো দেখতে এক হয় নারে '

হীরক জেদী গলায় প্রতিবাদ করল,'না! দোষ ওদের। ওরা ভালোটা ভাবতে পারে না। এজন্যই বীণা দল ছেড়ে চলে গেছে, তোর আমার ব্যাপার নিয়ে। শিহাব আমার সাথে আলগা। তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। মিনা ও দূরে। অবশ্য শুরুতে এরা কেউ ই আমার কাছে ছিল না।'

একই কষ্ট তৃণার ও মনে। সে বলল,' আমি সবাইকে ভুলে গেছি। '

হীরক জিজ্ঞেস করল,'আমাকেও? আমার তোকে দরকার। '

তৃণা হাসল,'আছি ইনশাআল্লাহ। '

হীরক সুখী হাসি হাসল, ' আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা, চল ক্লাসে যাই।'

ওরা মিনা, বীণা, শিহাব সবার সাথে একই ক্লাসে গিয়ে বসল। নিজেদের মত।

বিষয়: সাহিত্য

১০৯৩ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

298277
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:০১
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৪
241714
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck
298284
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:০৪
কাহাফ লিখেছেন : "এই নারকীয় উল্লাসের পৃথিবীতে মানুষটা ভিন্ন। শুরুটা তাদের অন্যদের মতই দেখাচ্ছিল। অন্য দশটা সম্পর্কের মত পরিণতি তারা চায়নি। যা হবে ফেয়ার হোক। চারপাশের পৃথিবীর সমস্ত অনাচারে ব্যথিত মন দুটি স্বেচ্ছায় সব চেনা জানা কিছু থেকে, সমস্ত বাজে অভ্যাস থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে এনেছে। তাদের পৃথিবী স্বচ্ছ, সুন্দর।"
নতুন দিনের-নতুন সালের আগমনে যথার্থ প্রত্যাশা ফুটে উঠেছে ......
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৫
241716
মামুন লিখেছেন : আপনার মন্তব্যটি অনেক ভালো লাগলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
298288
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:২০
হতভাগা লিখেছেন : '' কি করে তোকে বলবো .... তুই কে আমার ''

০ আগে প্রেমিক প্রেমিকারা পরষ্পরকে তুমি বলে সম্বোধন করতো । এখন সেটা তুই তে নেমে এসেছে ।
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৫
241718
মামুন লিখেছেন : হ্যা, এখনকার জুটিরা অতি-অগ্রগামি। এরা নিজেদেরকে খুব বেশী কাছের দেখাতে চায় হয়তো।
ধন্যবাদ আপনাকে।Good Luck Good Luck
298345
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৬
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : ভালো লাগল! তাই ভালোলাগা রেখে গেলাম।
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৬
241720
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগা রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck
298349
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৫
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আপনার গল্প বরাবরই ভিন্ন হয়। মনে হয় জীবনের খুব কাছ থেকে নেওয়া। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর গল্পটির জন্য
০১ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১০:১৯
241650
পুস্পগন্ধা লিখেছেন : আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আপনার গল্প বরাবরই ভিন্ন হয়। মনে হয় জীবনের খুব কাছ থেকে নেওয়া। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর গল্পটির জন্য

আপনার সাথে একমত, মামুন ভাইয়ের গল্প পড়লে মনে হয় উনি উনার নিজের কথা বলছেন....।
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৭
241722
মামুন লিখেছেন : আপনার অনুভূতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File